ভুলে যাওয়া নায়ক বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের শেষ লড়াই | The last battle of the forgotten hero Birendranath Duttagupta
স্যার, খুব খিদে লেগেছে। রোজই তো সেই একঘেয়ে জেলের খাবার খাই। আজ মনটা একটু অন্যরকম চাইছে। Home কচুরি-সিঙ্গাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে... যদি সামনের দোকান থেকে একটু এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন...
এজলাসে উপস্থিত পুলিশ-উকিল-মোক্তারদের হতচকিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন যুবক। কোর্ট লক-আপের ভিতরে দাঁড়িয়ে ফের আর্জি জানান ভালমন্দ খাওয়ার।
- জানি স্যার, নিয়মের তো বাঁধা আছে। তবু একদিন না হয় একটু ব্যতিক্রম হল! অস্ত্রশস্ত্র তো চাইছি না—শুধু কচুরি-সিঙ্গাড়া আর কয়েকটা রসগোল্লা। খাওয়ার শেষটা যদি একটু মিষ্টিমুখে হয়, ক্ষতি কী?”
আসামির এই সরল আবেদন শুনে পুলিশ কর্তা টেগার্ট নিচু স্বরে বললেন,
“ফাঁসি তো ওর হবেই। যা খেতে চাইছে, দিয়ে দাও। খুশি থাকুক। আমাদেরও ওকে এখনো একটু দরকার আছে।” golpo
আদালতে যখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, প্লেটে করে কচুরি-সিঙ্গাড়া-রসগোল্লা সাজিয়ে দেওয়া হল তাঁর সামনে। দিব্যি গুছিয়ে বসে খেলেন পেটপুরে এবং বিরতির পর নিশ্চিন্তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন নিয়মরক্ষার দণ্ডাদেশ শুনতে। জানাই তো আছে, কী সাজা ঘোষণা করতে চলেছেন বিচারক!
ঘড়ির কাঁটা সেদিন সাড়ে পাঁচটার দোরগোড়ায়। কলকাতার অফিসফেরতা মানুষের ভিড় থমকে গেল আচমকাই, স্তব্ধ হয়ে দেখছে রিভলভার হাতে উর্ধশ্বাস দৌড় এক যুবকের। যার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত ফুরিয়ে আসছে—পেছনে ধেয়ে আসছে পুলিশ বাহিনী। যুবকের হাতে উঠোনো রিভলভার, চোখে আতঙ্ক আর বিদ্রোহের মিশেল। মাঝেমধ্যেই সে পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তাক করে চিৎকার করছে—“খবরদার! আর এক পা এগোলেই গুলি চলবে!”
দম ফুরিয়ে আসছে। মাথাও আর কাজ করছে না যুবকের, পুলিশ ধরে ফেলল বলে। কী করবে এখন? কী করা উচিত? আরে, উল্টোদিক থেকেও তো দু’জন ছুটে আসছে। গায়ে উর্দি, মানে পুলিশ! এবার?
রিভলভার নিজের মাথায় ঠেকানোর আগেই পুলিশ যুবকের হাত চেপে ধরলেন। পিছনের পুলিশবাহিনীও ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেলেন না যুবক। ধরা দিতে হল। রিভলভার, কার্তুজ এবং ছোরা বাজেয়াপ্ত হল সব।
“তুমি সরকারের শ্যাম, আমাদের শূল
তোমার ভিটেয় চরবে ঘুঘু দেখবে চোখে সরষে-ফুল।”
ছড়াটা তখন মুখে মুখে ফিরত বাংলার বিপ্লবীদের। বানানো হয়েছিল ডাকসাইটে ডেপুটি সুপার সামসুল আলমকে নিয়ে | আলিপুর বোমার মামলায় পুলিশের তরফে সরকারি কৌঁসুলি মিস্টার নর্টনের ডান হাত ছিলেন সি.আই.ডি-র এই ডি.এস.পি-র অধীনে দশজন বাঙালি বিপ্লবীর উপর নেমে এসেছিল কঠোর দণ্ড। শুধু এই একটি ঘটনায় নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের যেকোনো মামলাতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন সামসুল মিঞা। মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করতে যেমন তিনি পারদর্শী, তেমনই দক্ষ ছিলেন শিশু-কিশোরদের প্রলোভনে ফেলে ‘রাজসাক্ষী’ বানাতে।
এমন এক পুলিশ অফিসার যে অচিরেই বিপ্লবীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবেন, তা ছিল একরকম নিশ্চিত।
এই সামসুলকে সরানোর দায়িত্ব বাঘা যতীন অর্পণ করেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এক তরুণের হাতে। তরুণটির জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে। মুখাবয়ব যেন শিলায় খোদাই করা—দৃঢ়, নির্ভীক, অনড়।
২৪শে জানুয়ারি ১৯১০.......
সামসুল দুপুরের একটু পরে এসেছেন হাইকোর্টে। নর্টন সাহেবের ঘরে বসেছেন অন্যদিনের মতোই। সঙ্গে এনেছেন একগুচ্ছ ফাইলপত্র, যাতে গচ্ছিত রয়েছে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। আলোচনা শেষ হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। দেহরক্ষীকে প্রস্তুত হতে বললেন সামসুল। More golpo
কিছুক্ষণ পর সরকারি কৌঁসুলির কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। সামনে এগিয়ে চলেছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল, যিনি নর্টন সাহেবের ঘরে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। পেছনে রয়েছে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। ঠিক তখনই, যখন তিনি পূর্ব দিকের সিঁড়িতে পা রাখতে যাচ্ছেন—সামনেই, যেন মৃত্যুদূত রূপে উদিত হল এক যুবক, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
অল্পবয়সী আগন্তুকের এভাবে পথ আটকে দাঁড়ানোয় ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত সামসুল। দেহরক্ষী ততক্ষণে দেখে ফেলেছেন, যুবক পরনের ফতুয়ার মধ্যে থেকে বার করছেন রিভলভার। বাধা দেওয়ার আগেই ‘দ্রাম’! করমর্দনের দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন । সামসুলের বক্ষস্থল ভেদ করল বুলেট, ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার আগে শুধু অস্ফুটে বলতে পেরেছিলেন, “পাকড়ো”!
পেছনে ধাওয়া করল পুলিশ। আদালত চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তখন হুলস্থুল কাণ্ড, চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব। সামসুলের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ ঘিরে ভিড় জমেছে, আর ঠিক সেইসাথে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে চরম উত্তেজনা।
“খুন! খুন!”—চিৎকারে থরথর করে কেঁপে উঠল হাইকোর্ট চত্বর। সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎগতিতে ছুটে বেরিয়ে এলেন যুবক, রাস্তায় নেমেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভিড়ের মাঝে। Home
কিন্তু ওই জনাকীর্ণ এলাকায় পালাবেন কোথায়? অশ্বারোহী পুলিশ তাড়া করেছে | হাইকোর্টের পাশের ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রীট ধরে ছুটতে ছুটতে যখন যুবক পৌঁছলেন হেস্টিংস স্ট্রীটে। দম ফুরিয়ে এসেছে। মাথা কাজ করছে না আর। পিছনে যারা তাড়া করছে, তাদের সঙ্গে ব্যবধান তো কমে এসেছেই, উল্টোদিক থেকেও দেখতে পাচ্ছেন কয়েকজন পুলিশকে দৌড়ে আসতে।
মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন যুবক। দ্বিধা কাটিয়ে যখন স্থির করলেন, আত্মহত্যাই শ্রেয়, ততক্ষণে একজন সার্জেন্ট উল্টোদিক থেকে তার হাত ধরে ফেলেছেন |
সামসুল-হত্যার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে যুবকের ওপর চলতে থাকল নির্মম নির্যাতন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকে জেরা করলেন সি.আই.ডি ও স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। কিন্তু সব চেষ্টা নিষ্ফল—যুবক একটিবারের জন্যও মুখ খোলেননি।
বাজিয়ে গেলেন একই কাটা রেকর্ড, “ডি.এস.পি সাহেবের উপর রাগ ছিল, উনি বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে অত্যাচার করেন বলে। যা করেছি, একাই করেছি। কারোর নির্দেশে নয়। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, নিয়েছি।”
হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো উকিলের সাহায্য নিতেও তিনি অস্বীকার করেন। বিচারপতি লরেন্স জেঙ্কিন্স ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে তাঁর উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু বিপ্লবীদের গুপ্ত সংবাদ প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় তিনি নিশীথ সেনকে একটিও কথা জানাননি। শেষ পর্যন্ত আদালতে দাঁড়িয়ে নিশীথ সেন তাঁকে ‘বিকৃতমস্তিষ্ক’ আখ্যা দিলেও, তাতে ফাঁসির রায় আটকানো যায়নি।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯১০, আলিপুর জেলে ফাঁসি হয়ে গেলো বাংলা মায়ের এক দামাল ছেলে বীরেন্দ্র নাথ দত্তগুপ্তের। বয়স হয়েছিল মাত্র একুশ !
English version 👉
The last battle of the forgotten hero Birendranath Duttagupta
Sir, I am very hungry. I eat the same boring prison food every day. Today my heart wants something different. I really want to eat kachuri-singara... If only they would arrange to bring some from the shop in front...
Looking at the shocked faces of the police, lawyers, and bailiffs present in the courtroom, the young man smiled. Standing inside the court lock-up, he again requested to eat good and bad.
- I know, sir, there are limits to the rules. But one day, at least, there is a little exception! I don't want weapons—just kachuri-singara and a few rasgollas. What's the harm if the end of the meal is a little sweet?"
Hearing this simple request of the accused, the police officer Taggart said in a low voice,
"He will be hanged. Give him whatever he wants to eat. Let him be happy. We still need him a little."
During the lunch break in the court, plates of kachori, singara and rosgolla were placed in front of him. He sat neatly and ate at Petpur and after the break, he stood calmly in the dock to listen to the sentence for maintaining order. You know what sentence the judge is going to pronounce!
The clock was ticking at 5:30 that day. The crowd of office-going people in Kolkata suddenly stopped, stunned to watch the breathless running of a young man with a revolver in his hand. The gap with him was rapidly closing—the police force was coming after him. The revolver in the young man's hand, a mixture of panic and rebellion in his eyes. Every now and then he turned around, pointing his weapon and shouted—"Beware! If you take one more step, you will be shot!"
He was running out of breath. The young man's head was no longer working, because the police had caught him. What should he do now? What should he do? Hey, two people are running from the opposite direction. They are wearing uniforms, I mean police! Now?
Before he could put the revolver to his head, the police force behind him grabbed the young man's hand. The police force behind him had also arrived by then. The young man did not get a chance to finish himself off. He had to be caught. The revolver, cartridges and knife were all confiscated.
"You are the government's son, our son
Doves will graze on your land, and they will see mustard flowers in their eyes."
The story was then being told by the revolutionaries of Bengal. It was made about Deputy Superintendent Shamsul Alam at the Daksite. In the Alipore bomb case, the police were the right hand of the government prosecutor Mr. Norton. Under this DSP of the CID, ten Bengali revolutionaries were severely punished. Not only in this one incident, but in any sedition case, Shamsul Miah was adept at plotting against the accused. As well as being adept at gathering false witnesses, he was equally skilled at luring children and teenagers to make them 'royal witnesses'.
It was certain that such a police officer would soon become the target of the revolutionaries.
Bagha Jatin entrusted the responsibility of removing this Shamsul to a young man he loved very much. The young man was born in Bikrampur, Dhaka. His face was as if carved in stone - firm, Fearless, adamant.
January 24, 1910.......
Shamsul arrived at the High Court a little after noon. He sat in Norton Sahib's room as if he were sitting on any other day. He brought with him a bunch of files containing important documents from the Alipore Conspiracy Case. The discussion ended by five in the afternoon. Shamsul asked his bodyguard to get ready.
After a while, he came out of the government prosecutor's office. The Advocate General, who was present at the discussion in Norton Sahib's room, was walking ahead. Behind him were armed security guards. Just as he was about to step onto the eastern stairs, a young man appeared in front of him, standing facing him, as if he were the angel of death.
Shamsul was momentarily unprepared for the young stranger blocking his way. The bodyguard had already seen the young man pulling out a revolver from inside his fatwa. Before he could stop him, 'Dram'! A handshake He fired from a distance. The bullet pierced Shamsul's chest, before Bhablila could only say in a muffled voice, "Catch him"!
The police chased after him. There was a commotion in the court premises and the surrounding area, a loud noise all around. A crowd gathered around Shamsul's bullet-riddled body, and at the same time, extreme tension spread outside.
“Murder! Murder!”—The High Court premises shook with a scream. At that moment, the young man ran out with lightning speed, and disappeared into the crowd as he stepped onto the street.
But where could he run in that crowded area? The mounted police were chasing him. When the young man reached Hastings Street while running along Old Post Office Street next to the High Court, he was out of breath. His head was no longer working. The gap with those chasing him had narrowed, and he could see a few policemen running from the opposite direction.
The young man was momentarily bewildered. When he decided that suicide was better, a sergeant grabbed his hand from the opposite side.
The brutal torture continued on the young man to find out the conspirators behind the murder of Shamsul. Experienced officers of the CID and Special Branch interrogated him for hours. But all efforts were in vain—the young man did not open his mouth even once.
He played the same old record, “I was angry with the DSP, because he arrested and tortured the revolutionaries. Whatever I did, I did alone. Not on anyone’s orders. I wanted to take revenge, so I took it.”
He refused to take the help of any lawyer to defend himself during the trial in the High Court. Justice Lawrence Jenkins appointed Barrister Nishith Sen as his lawyer. But fearing that the secret information of the revolutionaries would be revealed, he did not tell Nishith Sen a single word. In the end, even though Nishith Sen called him a ‘degenerate’ in court, it could not prevent the death sentence.
On February 21, 1910, Birendra Nath Duttagupta, a proud son of a Bengali mother, was hanged in Alipore Jail. He was only twenty-one years old!
Click next Home page
Comments
Post a Comment