‘আলেকজান্দ্রিয়া ফিডিং বোতল’ এক ভুল আবিষ্কারের মরণফাঁদ | The Alexandria Feeding Bottle is a death trap of a mistaken discovery
![]() |
শিশুর জন্য মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেই ভালোবাসাকেই সহজ করার নামে ইতিহাসে অনেক সময় কিছু আবিষ্কার এসেছে, যেগুলোর শেষ পরিণতি দাঁড়িয়েছে ভয়ংকর বিপদের নামান্তর হয়ে। এমনই এক উদাহরণ হলো ফিডিং বোতল, বিশেষ করে উনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে ব্যবহৃত তথাকথিত “আলেকজান্দ্রিয়া ফিডিং বোতল”, যাকে আরেক নামে ডাকা হতো “খুনি বোতল” বলে। কেন এমন নাম? সেই গল্প বুঝতে গেলে যেতে হবে রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনামলের ইংল্যান্ডে।
সে সময় সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আসছিল। শিল্পবিপ্লবের পর হাজার হাজার নারী কারখানায় কর্মরত ছিলেন। মাতৃত্বের পাশাপাশি গৃহকর্ম বা পেশাগত দায়িত্ব সামলানো ছিল অত্যন্ত কঠিন। তাই প্রয়োজন ছিল এমন কোনো উপায়ের, যাতে শিশু নিজেরাই দুধ পান করতে পারে এবং মা কিছুটা সময় নিজের কাজে ব্যয় করতে পারেন। এই চাহিদাকে কেন্দ্র করে তৈরি হলো নানা রকম ফিডিং বোতল, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে বোতলগুলোকে বলা হতো “বাঞ্জো বোতল”।
অদ্ভুত বঙ্কিম আকৃতির কারণে এই নাম। বোতলের একপাশ ফুলানো, আরেকপাশ চিকন, দেখতে অনেকটা বাঞ্জো বাদ্যযন্ত্রের মতো। দেখা গেল, খুব ছোট বয়সেও শিশুরা এই বোতল মুখে নিয়ে নিজেই দুধ চুষে খেতে পারে। তাই মা ব্যস্ত থাকলেও শিশুর খাওয়ার প্রক্রিয়া থেমে থাকত না। বিজ্ঞাপনে দেখানো হতো, এই বোতল ব্যবহার করলে শিশুরা নাকি আরও দ্রুত বড় হয়, আরও হাসিখুশি থাকে। নামও দেওয়া হতো আকর্ষণীয়, যেমন “মামিজ ডার্লিং”, “দ্য প্রিন্সেস”, “লিটল চেরাব” কিংবা সবচেয়ে বিখ্যাত “দ্য আলেকজান্দ্রিয়া”।
বাবা-মায়েরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, এই বোতলগুলোই যেন শিশুর যত্ন নেওয়ার নিখুঁত সমাধান। বোতল বিক্রির হার হু-হু করে বাড়তে লাগল। ধনী থেকে সাধারণ, প্রায় সব ঘরেই প্রবেশ করল এই বোতল। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল এমন এক বিপদ, যা ধীরে ধীরে শিশুদের মৃত্যুর ভয়াবহ কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কারণটা খুব সহজ। বোতলগুলো তৈরি হতো কাচ অথবা মাটির পাত্র দিয়ে, যা ভিজে থাকলে জীবাণু জন্মানোর জন্য আদর্শ জায়গা। তার ওপর সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল বোতলের নিপল থেকে বোতলের মূল অংশ পর্যন্ত লম্বা রাবারের নল। সেই নলের ভেতর জমা দুধ পচে যেত, তৈরি হতো প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়ার বাসা। আজকের দিনে হয়তো শুনে অবাক লাগবে, কিন্তু তখন জীবাণুবিদ্যা বা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা অনেক কম ছিল। ফলে এই নলগুলোর ভেতরে কী লুকিয়ে থাকতে পারে, কেউ চোখে দেখতেই পেত না। কিন্তু রোগ ছড়িয়ে পড়ছিল ভয়ানকভাবে।
![]() |
এর সঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। বাঞ্জো আকৃতির কারণে বোতলের ভেতরে কোথাও হাত পৌঁছাত না। নলটি পরিষ্কার করাও ছিল প্রায় অসম্ভব। দিনদিন বোতলের ভিতর জমে থাকা দুধের দাগ, গেঁজানো দুধের গন্ধ, আর অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়ার স্বর্গরাজ্যে শিশুদের দুধপান চলতেই থাকত।
এসময় ইংল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন মিসেস বিটন, যিনি তখনকার সমাজের কাছে ছিলেন একজন বিখ্যাত ‘লাইফস্টাইল গুরু’। তার Household Management বই তখন প্রায় প্রতিটি ইংরেজ পরিবারের হাতের নাগালে। তিনি সেখানে লিখেছিলেন, নিপল দুই থেকে তিন সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করলেই যথেষ্ট। ভাবা যায়? চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করছিলেন যে শিশুকে খাওয়ানোর সরঞ্জাম প্রতিবার ব্যবহারের পরই ফুটিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু জনপ্রিয়তার যুগ তখনও শুরু হয়েছে। সামাজিক প্রভাব বা প্রচার যার হাতে, মানুষ তার কথা শুনতেই বেশি পছন্দ করে। ডাক্তারদের সাবধানবাণী উপেক্ষিত হলো, আর মিসেস বিটনের পরামর্শকেই মনে করা হলো বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশ।
ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। “দ্য আলেকজান্দ্রিয়া” কিংবা অনুরূপ ফিডিং বোতলগুলোকে মানুষ তখন বলতে শুরু করল “দ্য কিলার”, “দ্য মার্ডারার”, “দ্য ইনফ্যান্ট স্লেয়ার”। অনেক চিকিৎসক সংবাদপত্রে প্রচারণা চালাতে শুরু করলেন। বললেন, মায়েরা নিজেদের অজান্তেই সন্তানদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে একের পর এক পরিসংখ্যানও প্রকাশ পেল।
ইংল্যান্ডে প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে মাত্র দুটি দ্বিতীয় জন্মদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকত। এই পরিসংখ্যান শুধু দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা বা রোগব্যাধির ফল নয়। বড় কারণ ছিল এই প্রাণঘাতী বোতলগুলোর ব্যবহার। অগণিত শিশুর জীবন অকালে থেমে গেল শুধুমাত্র একটি ভুল উদ্ভাবনকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস করার কারণে।
সময় যত এগোল, ডাক্তারদের গবেষণা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে লাগল। বোঝা গেল, শিশুকে খাওয়ানোর আদর্শ উপায় হলো মায়ের বুকের দুধ। এবং যদি বোতল ব্যবহার করতেই হয়, তবে তা এমন হবে যাতে প্রতিবার ব্যবহার শেষে সহজেই পুরোপুরি পরিষ্কার করা যায়। ১৯ শতকের শেষদিকে নতুন ধরনের বোতলের প্রচলন শুরু হলো, যেগুলোর নল ছিল না এবং গলার অংশ অনেকটা খোলা থাকত। এই বোতলগুলো মাঠে নামতেই আলেকজান্দ্রিয়া ধীরে ধীরে সাধারণ ব্যবহার থেকে বিলীন হয়ে গেল। মানুষের কাছে ফিরে এল কঠোর শিক্ষা—নতুন আবিষ্কার সবসময়েই উপকারী নয়।
তবু ইতিহাসের এই ভুলকে আমরা ভুলে গেলে চলবে না। কারণ আজও পৃথিবীর নানা দেশে স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে শিশুরা দুর্ভাগ্যের শিকার হচ্ছে। অনেকে এখনও মনে করেন, বিজ্ঞাপনে যেটা বলা হয় সেটাই সত্য। বিজ্ঞানীদের কথা তখনও অনেকের কাছে শোনা যায় না। অথচ তাদের পরামর্শই শিশুর ভবিষ্যৎ রক্ষার সবচেয়ে সঠিক পথ।
আলেকজান্দ্রিয়া ফিডিং বোতলের কাহিনি শুধু একটি বোতলের গল্প নয়। এটি মনে করিয়ে দেয়, অন্ধ বিশ্বাস কতটা বিপজ্জনক। প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনের প্রতি আমাদের আকর্ষণ থাকবেই। কিন্তু সেই আকর্ষণ যেন অন্ধতা না হয়ে ওঠে। পরীক্ষিত জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সভ্যতার পরিচয়। এবং বিশেষ করে শিশুর ক্ষেত্রে, মায়ের ভালোবাসা ও সতর্কতার সামনে কোনো নতুন আবিষ্কারই শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবি করতে পারে না।
ইতিহাস আমাদের শেখায়, ভুল থেকে ফিরে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। রানী ভিক্টোরিয়ার সময়কার সেই মারণ বোতল বহু শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেই ট্র্যাজেডি থেকেই আধুনিক শিশুস্বাস্থ্যের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হলো। আজ আমরা জানি, শিশুর নিরাপত্তা মানেই সতর্কতা, পরিচ্ছন্নতা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি অবিচল বিশ্বাস।


Comments
Post a Comment