মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ও শৈশব জীবন | The birth and childhood of Matangini Hazra
![]() |
| Matangini Hazra |
প্রথম গুলিটা লাগলো বামহাতে, শরীর থরথর করে কাঁপছে .. তবু দেশের পতাকা মাটিতে স্পর্শ করতে দিলেন না। ডানহাত থেকে শাঁখটি মাটিতে পড়ে গেল ... বামহাত থেকে ডানহাতে পতাকাটি নিলেন, শাঁখও তুললেন... উঁচুতে তুলে ধরে বললেন, 'বন্দে মাতরম'। এবারে গুলি করা হলো ডানহাতে .. বসে পড়লেন মাটিতে ...সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতো সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় পতাকা। এবারে কাপুরুষ পুলিশ অফিসার অনিল ভট্টাচার্য্যের নির্দেশে ৭৩ বছরের বৃদ্ধার কপাল লক্ষ্য করে গুলি করল। ক্ষিন কন্ঠে 'বন্দে .. মাতরাম' ... বলতে বলতে দেশমাতৃকার কোলে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়লেন অাজন্ম-সেবিকা মাতঙ্গিনী হাজরা ... তাঁর লাল রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে গেল ভবিষ্যত স্বাধীন দেশের মাটি ...Home
১৮৬৯ সালের ১৭ই নভেম্বর, তমলুকের কাছে হোগলা গ্রামের মাইতি পরিবারে তাঁর জন্ম। যদিও তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বাবা ঠাকুরদাস মাইতি এবং মা ভগবতী দেবী'র (বিদ্যাসাগরের বাবা-মা'য়ের নামে ছিল তাঁর বাবা মা'য়ের নাম) তিনি ছিলেন ছোট কন্যা।
মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবা ঠাকুরদাস আদরের সুদর্শনা 'মাতু'র বিয়ে দিলেন পাশের আলিনান গ্রামের সম্পন্ন কৃষক ৬০ বছরের ত্রিলোচন হাজরার সাথে। এটি ছিল ত্রিলোচন বাবুর দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় ত্রিলোচন বাবু মারা যান। নিঃসন্তান অবস্থায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিধবা হলেন মাতঙ্গিনী। এরপর যথারীতি স্বামীর সংসারে জায়গা না মেলায় পাশের এক জমিতে ঝুপড়ি কুটিরে আশ্রয় নেন। ধান ভাঁঙার কাজ করে নিজের জীবন চালাতে লাগলেন সদ্য বিধবা কিশোরী থেকে তরুণী মাতঙ্গিনী।
তরুণী অবস্থায় আত্ম-সুখ বিসর্জন দিয়ে বৈধব্য ব্রহ্মচর্য সাধনা শুরু করেন মাতঙ্গিনী হাজরা। দেশবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা স্বামী বিবেকানন্দর একটি বক্তব্য বাল্য বিধবা মাতু'কে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিল; স্বামীজি বলেছিলেন- '‘এখন থেকে আগামী পঞ্চাশ বছর তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা হবেন জননী-জন্মভূমি। তাঁর পূজো করো সকলে।’' তিনি উপলব্ধি করলেন দেশ ভারতবর্ষের মহান আদর্শ 'জনসেবা'। চেনা-অচেনা বিভিন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা করতে করতে একসময় তাঁর যোগাযোগ হয় পাশের সিউরি গ্রামের কংগ্রেস নেতা গুণধর ভৌমিকের (বিজ্ঞানী মণিলাল ভৌমিকের বাবা) সাথে। সেই সূত্রেই পরিচয় হয় অজয় মুখোপাধ্যায় এবং সতীশ সামন্ত'র মতো দুই দিকপাল নেতৃত্বের সাথে। তাঁদের মুখে মাতঙ্গিনী শুনলেন গান্ধীজীর কথা, তাঁর আদর্শ, ভাবনা ও আন্দোলনের কথা। তিনি গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতার কথা, গান্ধীজীর কথা প্রচার করতে লাগলেন; সেইসাথে চলল দুঃখি, আর্ত-পীড়িত মানুষের সেবা কাজ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেন দেশকে বিদেশীর শাসনমুক্ত করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে বড়ো ধর্ম আর কিছুই থাকতে পারে না। লোকে তাঁর নাম দিল 'গান্ধীবুড়ি'।
১৯২০ থেকে ১৯৪২ সাল - তিনি কংগ্রেসের প্রতিটি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন অসংখ্য সভা সমিতিতে, প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলেন অনেক কংগ্রেস সম্মেলনে, দিয়েছেন বক্তৃতা। লবণ সত্যাগ্রহ থেকে সরকারি কর বন্ধ আন্দোলন, আদালতে জাতীয় পতাকা তোলা, সামনে থেকে লাটসাহেব'কে কালো পতাকা দেখানো - সবেতেই জুটেছে পুলিশের নির্মম অত্যাচার, বহুবার খেটেছেন জেল। বিচারে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর মাতঙ্গিনী হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘'দেশের জন্য, দেশকে ভালোবাসার জন্য, দণ্ডভোগ করার চেয়ে বড়ো গৌরব আর কী আছে?’' তিনি বহরমপুর কারাগারে ছয় মাস বন্দী ছিলেন, হিজলি বন্দি নিবাসেও বন্দি ছিলেন দুই মাস।
আমাদের পড়াশোনার সাধারণ বই বা ইতিহাস বইতে মাতঙ্গিনী হাজরা'র আন্দোলনের কথা, আত্মত্যাগের কথা সে ভাবে লেখা নেই। মাতঙ্গিনী হাজরা কংগ্রেসের সদস্য পদ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনও বিপ্লবী সংগঠনে দিক্ষিত ছিলেন না; বা সমাজের সার্বিক মুক্তিকামী কোনও সংগঠনের কর্মীও ছিলেন না। তিনি ছিলেন মূলত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একজন নির্ভীক সৈনিক। মাতঙ্গিনী হাজরা ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা গান্ধীর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও অহিংস নীতির বদলে যেখানেই সহিংস আন্দোলন শুরু হয়েছে সেখানেই তিনি যোগ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, কোনও বাধ বিচার করেননি। তাই মাতঙ্গিনী হাজরা'র মৃত্যু কোন আবেগসর্বস্ব করুণ পরিণতি নয়, তা ছিল আজন্ম দেশ ও জন সাধনার মোক্ষফল।
১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, বেলা তিনটে। জনতার মিছিল এগিয়ে চলছে তমলুক থানা ও দিওয়ানি আদালতের দিকে .. তমলুক শহরের চারটে প্রধান প্রবেশপথে সেই মিছিল আটকানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে বিরাট ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী। বিপ্লবীদের মুখে স্লোগান, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘বন্দেমাতরম’। মেদিনীপুরের তমলুক শহরের উত্তর দিকের গ্রাম হোগলা, আলিনান, জ্যামিট্যা, সোয়াদিঘি, খোসখানা, ডিমারী, বিশ্বাস, ধলহারা, মথুরি, সিউরি থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ রূপনারায়ণ নদের পাড় ধরে হেঁটে আসছে স্লোগান দিতে দিতে। পায়রাটুঙ্গি খালের কাছে দেওয়ানি কোর্টের পেছনে বিশাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অহিংস জনতার মিছিলের পথ আটকে দাঁড়াল। আর এগোলেই গুলি করা হবে.. সঙ্গে চলল অকথ্য ভাষায় অপমানকর কথা আর অশ্রাব্য গালাগালি। ইংরেজ বন্দুকের সামনে তখন আগুনময় জনতা। হঠাৎই মথুরি গ্রামের ১৩ বছরের ছোট্ট রোগা বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে উত্তেজিত হয়ে ছিনিয়ে নিতে গেল নেট বন্দুক। সেই ছোট্ট বালককে পুলিশের বীরপুরুষরা বন্দুকের বাঁট আর বেয়োনেট দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে খোঁচা মেরে মেরে খুন করে ফেলল। ছোট্ট ছেলেটির মৃত্যুযন্ত্রণার বুকচেরা চিৎকার-আর্তনাদে হঠাৎই জনতা হতবাক দিশেহারা হয়ে যায়..
তমলুক থানা দখল করতে গিয়ে ইংরেজ পুলিশের বন্দুকের সামনে যখন মিছিল ছত্রভঙ্গ, তখন নিজে এগিয়ে এসে মিছিল'কে সঙ্গবদ্ধ করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা। পিছিয়ে আসা জনতাকে আহ্বান করে বলেন, '‘থানা কোন্ দিকে? সামনে, না পেছনে? সামনে এগিয়ে চলো .. হয় জয়, না হয় মরণ .. হয় এগিয়ে যাব, নয় মরব .. আমি সকলের আগে থাকব .. কেউ পিছিয়ে যেও না .. এসো .. আর যদি কেউ না আসো, তবে আমি একাই এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাব .. তাতে যদি মরতে হয় মরব, এসো আমার সঙ্গে।”
এক নিঃস্ব নিরক্ষর গ্রাম্য মেয়ের দেশসেবা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি - ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ - তাঁর আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে ... ঐ দিন দুই হাতে দুটো গুলি লাগার পর .. তিন নম্বর গুলিটা তাঁর বাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেছিল।
সে দিন মাতঙ্গিনী হাজরা ছাড়াও ব্রিটিশের গুলিতে তমলুকের মাটি লাল হয়েছিল মথুরি গ্রামের লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, দ্বারিবেরিয়ার পুরীমাধব প্রামাণিক, মাশুরির জীবনকৃষ্ণ বেরা, আলিনানের নগেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঘটুয়ালের পূর্ণচন্দ্র মাইতি, তমলুকের নিরঞ্জন জানা, কিয়াখালির রামেশ্বর বেরা, হিজলবেড়িয়ার নিরঞ্জন পাখিয়াল, খনিকের উপেন্দ্রনাথ জানা ও ভূষণচন্দ্র জানা এবং নিকাশীর বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী-সহ বারোজন দেশপ্রেমিক শহিদের তাজা রক্তে। আত্মবলিদান দিবসে বিনম্র প্রণাম ।
More related article:
The unknown history of the death of Socrates

Comments
Post a Comment