মহিলাদের বুকে কান পেতেই হৃদস্পন্দন শোনা। শালীনতা বজায় রাখতে জন্ম স্টেথোস্কোপের | Hearing a woman's heartbeat by placing her ear on her chest. The stethoscope was born to maintain modesty
উনিশ শতকের শুরুর দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে বহু বাধা দাঁড়িয়ে ছিল। বিশেষ করে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তখনকার চিকিৎসকদের ছিল সীমিত ক্ষমতা। আজ আমরা যেসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতির সাহায্যে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করতে পারি, সেই সময় সেসবের অস্তিত্বই ছিল না। অথচ রোগীকে বাঁচানোর দায়িত্ব তখনও চিকিৎসকদের হাতেই। কিন্তু অনেক সময় সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁদের পড়তে হত অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিশেষ করে মহিলা রোগীদের হৃদস্পন্দন বা ফুসফুসের আওয়াজ পরীক্ষা করার জন্য চিকিৎসকদের বুকে কান পেতে শুনতেই হত। রোগীর শালীনতা বজায় রাখা এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে একটি কঠিন টানাপোড়েন ছিল।
এই সমস্যারই সঠিক সমাধান নিয়ে হাজির হন ফরাসি চিকিৎসক রেনে থিওফিল হ্যায়সিন্থ লেনেক। তাঁর আবিষ্কার শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের গতিপথ বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে চিকিৎসা গ্রহণের শালীনতা, নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসকেও।
লেনেকের দ্বিধা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
তৎকালীন সমাজে নারীদের শরীর সংক্রান্ত যেকোনো চিকিৎসা পরীক্ষায় ছিল কঠোর সামাজিক বারণ। পুরুষ চিকিৎসকের সামনে একজন নারী বুক খোলা বা ঘনিষ্ঠ পরীক্ষায় অংশ নিতে লজ্জা পেতেন, আবার ডাক্তারও মানসিক দোটানার মধ্যেই থাকতেন। লেনেক নিজেও এই নৈতিক সংকটের বাইরে ছিলেন না। তিনি প্রতিদিনই নানান রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে অনুভব করতেন, এভাবে কান পেতে বুকে শোনা শালীনতার পরিপন্থী। একই সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করতেন রোগীকে চিকিৎসা না করাও সমান অনৈতিক।
এই দোটানার কারণে তিনি অনেক সময় হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে থেকে গেছেন। কিন্তু দায়িত্ববোধ তাঁকে আবার ফিরিয়ে এনেছে নেকার হাসপাতালে, যেখানে তিনি কর্মরত ছিলেন। রোগীর মুখ থেকে হতাশার কান্না শুনে তিনি বুঝেছিলেন, চিকিৎসক কখনো দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
![]() |
হঠাৎ পাওয়া সমাধানের অনুপ্রেরণা
লেনেকের জীবনের সেই দৃশ্যটি আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। প্যারিসের পথে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি দেখলেন দুই শিশু একটি লম্বা কাঠের বা কাগজের চোঙ দিয়ে খেলছে। একজন চোঙের একদিকে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে, অপরজন চোঙের অন্যদিকে কান লাগিয়ে শুনছে। শব্দ অনেক জোরে পৌঁছে যাচ্ছে।
লেনেক থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখের সামনে যেন অন্ধকার ভেদ করে আলো জ্বলে উঠল। যদি একটি ফাঁপা নল শব্দকে এতটা জোরালো করতে পারে, তবে হৃদস্পন্দনের ক্ষীণ শব্দও কি একই পদ্ধতিতে শোনা যাবে না? বিশেষ করে দূরত্ব বজায় রেখে এবং শালীনতার ক্ষতি না করেই?
সেই রাতে আর ঘুম এল না তাঁর চোখে। পরীক্ষার উত্তেজনায় তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন পরদিনের জন্য।
স্টেথোস্কোপের জন্ম
পরদিন হাসপাতালে যখন এক স্থূলকায় তরুণী হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে এলেন, লেনেক তাঁর ওষুধ লেখার নোটবুকটিকে রোল করে চোঙের মতো বানালেন। সেই চোঙের এক দিক রোগীর বুকে ঠেকিয়ে, নিজের কান লাগাতেই তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন হৃদযন্ত্রের স্পন্দন। এতদিনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এক নিমেষে বদলে গেল। রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের জন্যই জন্ম নিল নতুন সুরক্ষা।
এই সাফল্যের পর লেনেক কাঠ দিয়ে একটি নল তৈরি করলেন এবং তার নাম দিলেন “সিলিন্ডার”। ১৮১৬ সাল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা।
এই নতুন যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের নানা রোগ সনাক্ত করতে শুরু করলেন। তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতির নাম দেওয়া হল মিডিয়েট অসকাল্টেশন অর্থাৎ যন্ত্রের সহায়তায় শব্দ শোনা।
শুরুতে উপহাস, শেষে জয়
বিস্ময়কর হলেও সত্য, লেনেকের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে প্রথমদিকে ভালো চোখে দেখা হয়নি। অনেক চিকিৎসকই এটিকে অপ্রয়োজনীয় কিংবা হাস্যকর বলেছিলেন। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে, একটি কাঠের নলের সাহায্যে চিকিৎসা করা কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়।
কিন্তু গবেষণা, পরীক্ষার ফলাফল এবং চিকিৎসায় সফলতার মাধ্যমে লেনেক প্রমাণ করে দিলেন device নয়, ফলাফলকেই গুরুত্ব দিতে হবে। চার বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর পদ্ধতি।
১৮৫১ সালে আইরিশ চিকিৎসক আরথার লেয়ার্ড এই যন্ত্রটিকে আরও উন্নত করে দুই কানে ব্যবহারযোগ্য করে তুললেন। আধুনিক স্টেথোস্কোপের জন্ম সেখান থেকেই।
লেনেকের অন্যান্য অবদান
স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের বাইরে লেনেকের আরও বিশাল অবদান রয়েছে। বিশেষ করে যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে তিনি যে গবেষণা করেছিলেন, তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের অমূল্য সম্পদ। তিনি যক্ষ্মার বিভিন্ন লক্ষণ, রোগটির ছড়িয়ে পড়ার ধরন এবং অসকাল্টেশনে যে শব্দ শোনা যায় তার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।
দুঃখজনক সত্য, সারাজীবন যক্ষ্মার রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে তিনিই আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুও হয়েছিল এই রোগেই। নিজের রোগের সঙ্গে লড়াই করে চলতে চলতেই তিনি চিকিৎসা জ্ঞানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যান।
লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করায় আজও সেই রোগের এক বিশেষ রূপকে বলা হয় লেনেক সিরোসিস। শবব্যবচ্ছেদ এবং রোগ নির্ণয়ের সম্পর্কও তিনিই প্রথম স্পষ্ট করে তুলে ধরেন।
দুঃখজনক সমাপ্তি, অমর অবদান
১৮২৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাধর চিকিৎসক। কিন্তু তাঁর আবিষ্কার ছাড়া কি আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানকে কল্পনা করা যায়? ডাক্তার মানেই গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো, এটি যেন চিকিৎসা পেশার প্রতীক হয়ে গেছে।
লেনেক হয়তো বেঁচে থাকলে দেখতেন, তাঁর আবিষ্কার কিভাবে গোটা পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। শুনতে পেতেন সেই সব রোগীদের কৃতজ্ঞতার শব্দ, যারা হয়তো তাঁর আবিষ্কারেই ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন।
উপসংহার
শালীনতা রক্ষা আর বিজ্ঞানচর্চা— এই দুইয়ের নিখুঁত সমন্বয়ই স্টেথোস্কোপের জন্ম। রেনে লেনেক প্রমাণ করে দিয়েছেন, মানবিক দায়িত্ব থেকে জন্ম নেওয়া ভাবনা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে।
আজ দুই শতকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। তবু লেনেককে ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তাঁর নীরব আবিষ্কার প্রতিদিন ডাক্তারদের হাতে জীবন রক্ষার হাতিয়ার হয়ে কাজ করে চলেছে। বুকে কান পেতে শোনার অস্বস্তিকর সময়ের অবসান ঘটিয়ে তিনি যে নিরাপত্তার আবরণ তৈরি করে গেছেন, তা চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে।
More article:


Comments
Post a Comment