মঙ্গল গ্রহের বিশাল ক্ষতচিহ্ন — ভ্যালেস মেরিনারিস || The giant scar on Mars — Valles Marineris
মহাবিশ্বের এক অনন্য বিস্ময় হলো মঙ্গল গ্রহ। এই লালচে গ্রহটির বুক জুড়ে আছে এমন অনেক রহস্য, যা আজও বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রে। কিন্তু মঙ্গলের পৃষ্ঠে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটি হলো এক বিশালাকার গিরিখাত — ভ্যালেস মেরিনারিস (Valles Marineris)। এটি শুধু মঙ্গলেরই নয়, পুরো সৌরজগতের সবচেয়ে বড় ক্যানিয়ন ব্যবস্থা। যেন এক দৈত্যাকার ক্ষতচিহ্ন, যা মঙ্গলের গায়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোটি কোটি বছর ধরে।
কতটা বিশাল এই ভ্যালেস মেরিনারিস?
ভ্যালেস মেরিনারিসের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,৫০০ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তুলনায় প্রায় দশগুণ বড়। এর প্রস্থ প্রায় ৬০০ কিলোমিটার, আর গভীরতা গড়ে ৭ থেকে ১১ কিলোমিটার পর্যন্ত! যদি এটি পৃথিবীতে থাকত, তবে এটি নিউ ইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। এই পরিসংখ্যান শুনলেই বোঝা যায়, এটি কেবল একটি গিরিখাত নয় — বরং এক মহাজাগতিক বিস্ময়।
কীভাবে তৈরি হলো এই বিশাল গিরিখাত?
বিজ্ঞানীদের মতে, ভ্যালেস মেরিনারিসের উৎপত্তি ঘটেছে প্রায় ৩.৫ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর আগে, যখন মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ টেকটোনিক শক্তি দুর্বল হতে শুরু করে। সেই সময় গ্রহের অভ্যন্তরের ম্যাগমা ঠান্ডা হয়ে জমে যায়, ফলে পৃষ্ঠে চাপ সৃষ্টি হয় এবং ভূমি ফেটে যেতে থাকে। এই ফাটলগুলো ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে বিশাল গিরিখাতে রূপ নেয়।
তবে শুধুমাত্র টেকটোনিক ক্রিয়া নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় (erosion), ধূলিঝড়, এবং সম্ভবত জলপ্রবাহের প্রভাবেও এই উপত্যকা আরও বিস্তৃত হয়েছে। কিছু অঞ্চলে প্রাচীন নদীর চিহ্ন বা জলীয় ক্ষয়ের দাগ পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে মঙ্গলের অতীতে একসময় তরল পানি প্রবাহিত হতে পারে।
নাসার চোখে ভ্যালেস মেরিনারিস
NASA-এর Mars Reconnaissance Orbiter (MRO) যখন মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে, তখন তার HiRISE ক্যামেরা থেকে পাওয়া ছবিগুলো আমাদের সামনে নতুন জগত খুলে দেয়। সেসব ছবিতে দেখা যায় বিশাল গিরিখাতের দেয়াল, যেখানে স্তর স্তর পাথর জমে আছে যেন সময়ের ইতিহাসের পৃষ্ঠা। এই স্তরগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন— মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে একাধিক যুগের চিহ্ন লুকিয়ে আছে।
কিছু অঞ্চলে এমনও প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, গিরিখাতের ভেতরে একসময় হ্রদ বা নদী ছিল। অর্থাৎ, এই অঞ্চলটি মঙ্গলের “জলীয় অতীতের” এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বহন করছে। আর এই কারণেই ভবিষ্যতের মঙ্গল মিশনের জন্য ভ্যালেস মেরিনারিস একটি সম্ভাবনাময় গন্তব্য।
ভ্যালেস মেরিনারিসের অংশবিশেষ
ভ্যালেস মেরিনারিস শুধু একটি খাত নয়; এটি একটি বিশাল গিরিখাতের সমষ্টি। এর বিভিন্ন অংশের নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন—
Candor Chasma – এখানে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
Ophir Chasma – উঁচু দেয়াল এবং জটিল ভূমি বিন্যাসের জন্য বিখ্যাত।
Melas Chasma – সম্ভবত একসময় পানিতে ভরা হ্রদ ছিল।
Coprates Chasma – গিরিখাতের দীর্ঘতম অংশগুলোর একটি।
এই প্রতিটি অঞ্চলের গঠন ও উপাদান আলাদা, যা মঙ্গলের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশগত বিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় প্রকাশ করে।
ভবিষ্যতের মঙ্গল মিশনে এর গুরুত্ব
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভ্যালেস মেরিনারিস এক প্রকার “টাইম ক্যাপসুল”, যা মঙ্গলের অতীতের গল্প লুকিয়ে রেখেছে। এখানকার শিলা ও খনিজের স্তরগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যেতে পারে মঙ্গলে কখন এবং কীভাবে পানি ছিল, এমনকি প্রাণের সম্ভাবনা সম্পর্কেও সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
এ কারণেই নাসা, ইএসএ এবং ভবিষ্যতের বেসরকারি মঙ্গল মিশনগুলো এই অঞ্চলকে অগ্রাধিকারে রাখছে। সম্ভব হলে এখানেই প্রথম মানব মিশন পরিচালনার পরিকল্পনাও করা হতে পারে, কারণ উপত্যকার প্রাচীরগুলো ভবিষ্যৎ নভোচারীদের আশ্রয় দিতে সক্ষম হতে পারে রেডিয়েশন থেকে সুরক্ষার জন্য।
পৃথিবীর তুলনায় পার্থক্য
পৃথিবীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হয়েছিল মূলত কলোরাডো নদীর জলীয় ক্ষয়ে। কিন্তু মঙ্গলের ভ্যালেস মেরিনারিসের জন্ম হয়েছে একদম ভিন্ন প্রক্রিয়ায় — টেকটোনিক ফাটল ও আগ্নেয়গিরির প্রভাবে। তাই এই দুই গিরিখাতের মধ্যে তুলনা করা মানে দুই ভিন্ন জগতের ইতিহাস তুলনা করা।
তবুও, উভয়ই আমাদের শেখায় যে, সময় ও প্রকৃতির শক্তি কেমন করে একটি গ্রহের পৃষ্ঠকে গড়ে তুলতে পারে।
উপসংহার
ভ্যালেস মেরিনারিস শুধু একটি গিরিখাত নয়, এটি মঙ্গলের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কোটি কোটি বছরের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাক্ষী এই “লাল গ্রহের ক্ষতচিহ্ন” আজও মানবজাতির কৌতূহল জাগায়। হয়তো একদিন মানুষ সরাসরি সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে, স্পর্শ করবে সেই শিলাস্তরগুলোকে, আর খুঁজে বের করবে মঙ্গলের হারানো ইতিহাস।
যতদিন না সেই দিন আসে, ততদিন ভ্যালেস মেরিনারিস আমাদের কল্পনায় জেগে থাকবে — মহাবিশ্বের এক নীরব বিস্ময় হিসেবে।
More related article
আমরা মারা যাই না, থাকি -থেকে যাই We don't die, we live

.jpeg)

.jpeg)
%20(7).jpeg)

.jpeg)
Comments
Post a Comment