ভিক্টোরিয়ান যুগের কর্সেট সৌন্দর্যের আবরণে লুকানো যন্ত্রণার ইতিহাস | The history of suffering hidden behind the veil of Victorian-era corset beauty
![]() |
| Victorian era |
১. ভূমিকা: সৌন্দর্যের মানদণ্ডের ইতিহাস
মানবসভ্যতার প্রতিটি যুগেই সৌন্দর্যের ধারণা সময়ের সাথে পাল্টে গেছে। কোথাও লম্বা চুলকে নারীত্বের প্রতীক ধরা হয়েছে, কোথাও ফর্সা ত্বককে শ্রেষ্ঠ ভাবা হয়েছে, আবার কোথাও মোটা ঠোঁট বা দীর্ঘ গড়ন ছিল আকর্ষণের মানদণ্ড। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে, বিশেষত ইংল্যান্ডে, নারীর সৌন্দর্য এক বিশেষ শরীরিক গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল—পাতলা কোমর, উঁচু বুক, আর প্রশস্ত নিতম্ব। এই আওয়ারগ্লাস আকৃতি অর্জনের প্রধান উপকরণ ছিল কর্সেট, যা শুধু পোশাক নয়, ছিল সামাজিক অবস্থান ও নারীত্বের প্রতীক। Story
২. কর্সেটের উৎপত্তি ও বিবর্তন
কর্সেটের ইতিহাস অনেক পুরনো। ষোড়শ শতাব্দীতেই ইউরোপে নারীরা শরীরকে আকৃতি দিতে কর্সেটজাত পোশাক পরতেন। তবে ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭–১৯০১) এটি হয়ে ওঠে ফ্যাশনের কেন্দ্রবিন্দু। এই সময় সমাজে নারীর পোশাক কেবল রুচির পরিচায়ক ছিল না, বরং তা ছিল শ্রেণি, মর্যাদা ও শালীনতার প্রতীক।
কর্সেট সাধারণত হাড়, ধাতু বা শক্ত চামড়ার ফ্রেমে তৈরি হতো, যা কোমরের চারপাশে এমনভাবে আঁটা থাকত যে শরীরের প্রকৃত আকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যেত। অনেক ক্ষেত্রে কর্সেটের ফিতে এমনভাবে টানা হতো যে কোমরের পরিধি ১৮ ইঞ্চির নিচে নামিয়ে আনা হতো—যা স্বাভাবিক শারীরিক গঠনকে বিকৃত করত।
![]() |
| Victorian era London |
৩. সামাজিক চাপ ও নারীর অবস্থান
ভিক্টোরিয়ান সমাজে নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল পরিপাটি পোশাক, বিনয়ী আচরণ ও নিখুঁত দেহগঠন। সৌন্দর্য তখন ছিল সামাজিক মূল্যবোধের অংশ। এক নারী কতটা “সুশিক্ষিতা” বা “উচ্চবিত্ত” তা অনেক সময় তার পোশাকের ধরন দিয়েই বিচার করা হতো।
এই সমাজে কর্সেট শুধু সৌন্দর্যের নয়, নৈতিকতার প্রতীক হিসেবেও দেখা হতো। একজন নারী যদি কর্সেট না পরতেন, তবে তাঁকে অবিনয়ী বা “অসভ্য” ভাবা হতো। ফলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্যই নারীরা নিজের দেহকে যন্ত্রণার মধ্যে আবদ্ধ করতে বাধ্য হতেন।
৪. কর্সেটের শারীরিক প্রভাব
চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করেছিলেন যে কর্সেট শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
প্রধান ক্ষতির দিকগুলো ছিল—
শ্বাসকষ্ট: কর্সেট ফুসফুসের স্বাভাবিক প্রসারণে বাধা দিত, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো।
হাড় বিকৃতি: দীর্ঘদিন কর্সেট পরলে পাঁজরের হাড় বেঁকে যেত এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ গঠন পরিবর্তিত হতো।
অভ্যন্তরীণ অঙ্গের স্থানচ্যুতি: হৃদপিণ্ড, লিভার ও পাকস্থলীর অবস্থান স্থানচ্যুত হয়ে নানা জটিল রোগ দেখা দিত।
রক্তচাপ ও অজ্ঞান হওয়ার প্রবণতা: টাইট কর্সেট রক্তসঞ্চালনে বাধা দিত, ফলে অনেক নারী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়তেন।
তবু এই সব কষ্টকে নারীরা নীরবে মেনে নিতেন, কারণ সমাজ তাঁদের শিখিয়ে দিয়েছিল—“সুন্দর হওয়া মানেই মূল্যবান হওয়া।” Home
৫. ফ্যাশন বনাম বাস্তবতা
কর্সেট শুধু পোশাক ছিল না, বরং এটি ছিল এক প্রকার মানসিক কারাগার। সমাজে যে নারী যত বেশি আঁটসাঁট কর্সেট পরতেন, তাঁকে তত বেশি রুচিশীল বলে ধরা হতো। ফলে ফ্যাশনের নামে প্রতিযোগিতা শুরু হয়—কে কত সরু কোমর দেখাতে পারেন।
ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো কর্সেট-নির্ভর পোশাককে “নারীত্বের সৌন্দর্য” হিসেবে প্রচার করত। এমনকি সাহিত্য ও চিত্রকলায়ও এই দেহগঠনকে আদর্শ হিসেবে দেখানো হতো। ফলস্বরূপ, বাস্তবের নারী নিজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভুলে গিয়ে এক কৃত্রিম দেহে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন।
![]() |
| Victorian era painting |
৬. চিকিৎসক ও সমাজ সংস্কারকদের প্রতিবাদ
উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে কিছু চিকিৎসক ও নারী সমাজ সংস্কারক কর্সেটবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা যুক্তি দেন—
১. সৌন্দর্যের মানদণ্ড কখনো স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিনিময়ে হতে পারে না।
২. নারী যদি সমাজে সমান মর্যাদা চান, তবে তাঁকে শরীর নয়, মেধা ও আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে আসতে হবে।
“র্যাশনাল ড্রেস মুভমেন্ট” নামের এক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই দাবিগুলো ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটেন ও আমেরিকায়। এই আন্দোলন কর্সেটের বিকল্প হিসেবে ঢিলেঢালা পোশাক প্রচলনের আহ্বান জানায়।
৭. পরিবর্তনের সূচনা
বিশ শতকের শুরুতে ফ্যাশনে বড় পরিবর্তন আসে। ১৯১০ সালের পর ধীরে ধীরে কর্সেটের ব্যবহার কমে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, আর কঠোর কর্সেটের পরিবর্তে ব্যবহার করেন আরামদায়ক পোশাক।
কোকো শ্যানেল নামের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার নারীদের জন্য মুক্ত গঠনবিশিষ্ট পোশাক চালু করেন, যা চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয় এবং সৌন্দর্যকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করে। এভাবেই কর্সেট ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যেতে শুরু করে।
৮. আধুনিক যুগে কর্সেটের প্রত্যাবর্তন
যদিও আজ আর কেউ প্রতিদিন কর্সেট পরে না, তবুও আধুনিক ফ্যাশনে কর্সেট-অনুপ্রাণিত ডিজাইন এখনো জনপ্রিয়। র্যাম্প শো বা রেড কার্পেট লুকে অনেকেই কর্সেট স্টাইলের পোশাক ব্যবহার করেন। তবে আজকের কর্সেট কেবল শৈল্পিক উপাদান, এটি আর যন্ত্রণার প্রতীক নয়।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি সত্যিই সেই মানসিক কর্সেট থেকে মুক্ত হতে পেরেছি, যা সমাজ এখনো নারীদের শরীর নিয়ে তৈরি করে?
৯. সৌন্দর্যের দর্শন: ইতিহাসের শিক্ষা
ভিক্টোরিয়ান যুগের কর্সেট শুধু পোশাকের ইতিহাস নয়, এটি মানুষের মানসিকতার ইতিহাস। এটি দেখায়, কিভাবে সমাজ সৌন্দর্যের সংজ্ঞা তৈরি করে এবং নারীরা সেই সংজ্ঞার বন্দি হয়ে পড়ে।
ইতিহাস আমাদের শেখায়—সৌন্দর্য মানে শারীরিক নিখুঁততা নয়, বরং আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস। একজন নারী যদি নিজের শরীরকে ভালোবাসতে শেখেন, তবে তিনি কর্সেট ছাড়াও পরিপূর্ণ।
১০. উপসংহার
ভিক্টোরিয়ান যুগে কর্সেট ছিল বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক, কিন্তু তার ভেতরে ছিল অদৃশ্য কষ্ট ও নিঃশব্দ প্রতিবাদ। নারীরা যে যন্ত্রণা সয়ে সৌন্দর্যের আদর্শ পূরণ করতেন, তা আসলে সমাজের চাপেরই প্রতিফলন।
আজকের যুগে আমরা শরীরের স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের কথা বলি, তবুও সামাজিক মিডিয়া ও ফ্যাশন ট্রেন্ড আমাদের নতুন ধরণের কর্সেটে আবদ্ধ করছে—কখনো ফিল্টারের, কখনো মানসিক তুলনার।
অতএব, ইতিহাসের কর্সেট আমাদের মনে করিয়ে দেয়,
সৌন্দর্যের জন্য শরীরকে নয়, মনকে গড়াই সবচেয়ে বড় শিল্প।
More article :
The most beautiful face in the world
মঙ্গল গ্রহের বিশাল ক্ষতচিহ্ন — ভ্যালেস মেরিনারিস || The giant scar on Mars — Valles Marineris



,_Princesse_de_Broglie_MET_DT717.jpg)

Comments
Post a Comment