বাঁকানো ব্যারেলের অদ্ভুত বন্দুক – Krummlauf যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্ভাবনের এক বিচিত্র অধ্যায় | The strange gun with a curved barrel Krummlauf a bizarre chapter in battlefield innovation
![]() |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষগুলোর একটি। এই যুদ্ধে অস্ত্র-শস্ত্রের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষামূলক ও অদ্ভুত উদ্ভাবন দেখা গিয়েছিল। সেই সব উদ্ভাবনের মধ্যে অন্যতম একটি ছিল জার্মানদের তৈরি Krummlauf—একটি বাঁকানো ব্যারেলযুক্ত বন্দুক, যাকে সহজ ভাষায় বলা হয় “Bent Barrel Rifle।”
যদিও এটি একটি স্বতন্ত্র রাইফেল ছিল না; বরং বিখ্যাত StG-44 অ্যাসল্ট রাইফেলের জন্য তৈরি বিশেষ ব্যারেল অ্যাটাচমেন্ট, যেটি ব্যারেলকে ৩০°, ৪৫°, এমনকি ৯০° পর্যন্ত বাঁকানো অবস্থায় গুলি ছোড়ার সুযোগ দিত। প্রথম দর্শনেই এই অস্ত্র মনে করিয়ে দেয়—যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য মানুষ কত রকম পথ খুঁজে নিতে পারে!
যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যা থেকেই ধারণার জন্ম
১৯৪৩ সালের দিকে এই ধারণার জন্ম হয় মাউসার কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায়। যুদ্ধ ক্রমশ শহরমুখী হতে শুরু করেছে—রাস্তার মোড়, বিল্ডিংয়ের কোণা, ধ্বংসস্তূপের আড়াল, কিংবা ট্যাঙ্কের ফাঁকা থেকে শত্রুকে লক্ষ্য করা—এসব পরিস্থিতিতে সরাসরি মাথা কিংবা দেহ বাইরে বের করে তাক করা ছিল আত্মহত্যার সামিল।
সৈন্যরা এমন অস্ত্র চাচ্ছিলেন, যা—
আড়াল থেকে গুলি করতে সাহায্য করবে
সুযোগ-সুবিধা বাড়াবে
শত্রুকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আঘাত হানতে দেবে
ফলে সৃষ্টি হলো Krummlauf—একটি “কোণ ঘুরে গুলি ছোড়ার” সমাধান।
![]() |
Krummlauf-এর দুটি প্রধান ব্যবহার
১৯৪৪ সালে প্রথম কার্যকর মডেল তৈরি হওয়ার পর এটি দুটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়—
1️⃣ ইনফ্যান্ট্রি ভার্সন
—পায়ে হেঁটে যুদ্ধরত সৈন্যরা ব্যবহার করতেন
—বাড়ির কোণা বা ট্রেঞ্চের বাঁকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে সুবিধা দিত
2️⃣ ট্যাঙ্ক-মাউন্টেড ভার্সন
—StG-44 ট্যাঙ্কের দেয়ালে বিশেষ ফিটিংয়ের মাধ্যমে লাগানো হতো
—ট্যাঙ্কের বাইরে মাথা না বারিয়েই আশপাশ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরক্ষা করা যেত
অতিরিক্ত হিসেবে একটি পারিস্কোপ সাইট লাগানো থাকত, যার মাধ্যমে শ্যুটার সহজেই লক্ষ্য দেখতে পারত।
যুদ্ধক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ সুবিধা এনে দিয়েছিল।
কিন্তু সুবিধার পাশাপাশি সমস্যা ছিল ভয়াবহ
যুদ্ধক্ষেত্রের রূঢ় বাস্তবতা দ্রুতই প্রমাণ করে দেয় যে এই অস্ত্র উদ্ভাবনী হলেও যথেষ্ট কার্যকর নয়। সমস্যাগুলো ছিল মূলত—
🔹 ব্যারেলের অভ্যন্তরীণ চাপ
বাঁকানো ব্যারেলের মধ্যে দিয়ে গুলি ছুটে গেলে
⬇
অস্বাভাবিক ঘর্ষণ সৃষ্টি হতো
⬇
ব্যারেলের ধাতু দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হতো
ফলে অস্ত্রটি খুব অল্প সময়েই অচল হয়ে পড়ত।
🔹 সীমিত আয়ুষ্কাল
ব্যারেল যত বেশি বাঁকা, আয়ু তত কম—
৩০° ব্যারেল → সর্বোচ্চ ~৩০০ রাউন্ড
৪৫° ব্যারেল → আরও কম
৯০° ব্যারেল → প্রায় ১০০ রাউন্ড—তারপরই অচল!
🔹 গুলির গতি কমে যেত
ব্যারেল বাঁকানো থাকায় গুলির ভরবেগ হ্রাস পেত, লক্ষ্যভেদে নির্ভুলতা কমত।
🔹 বুলেট ছিটকে যাওয়ার ঝুঁকি
কখনও কখনও গুলি ব্যারেলের ভিতরেই ভেঙে চূর্ণ বিস্ফোরণের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করত।
সুতরাং জীবন বাঁচাতে তৈরি করা অস্ত্রই কখনও কখনও উল্টো বিপদ ডেকে আনত!
![]() |
কেন সফল হতে পারেনি?
যদিও ধারণা ছিল যুগান্তকারী, তবুও বাস্তবে—
উৎপাদন খরচ বেশি
রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন
যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নয়
এতসব সীমাবদ্ধতার কারণে ১৯৪৫ সালেই এর পূর্ণ উৎপাদন বন্ধ করা হয়। মিত্রবাহিনীর অগ্রগতিতে যুদ্ধের মোড় বদলে গেলেও এই অস্ত্র কখনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি।
আজও ইতিহাসে বেঁচে আছে
যুদ্ধ শেষে অল্প কিছু Krummlauf বিশ্বব্যাপী সামরিক জাদুঘর বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে স্থান পায়। আজ এগুলো—
একাধিক সংগ্রাহকের নিকট দুর্লভ কালেক্টরের আইটেম
সামরিক উদ্ভাবনের অদ্ভুত ইতিহাসের প্রমাণ
এর সঠিক বাজারমূল্য অনেকটা নির্ভর করে অবস্থা ও প্রমাণিকতার ওপর, তবে আগের তুলনায় এখন এটি অত্যন্ত দামী এবং সংগ্রাহকদের কাছে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন।
![]() |
যুদ্ধের উদ্ভাবন মানব প্রবৃত্তির প্রতিফলন
Krummlauf কখনও যুদ্ধের ভাগ্য পাল্টাতে পারেনি। কিন্তু এটি স্মরণ করিয়ে দেয়—
যুদ্ধ মানুষকে যতটা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়, ততটাই উদ্ভাবনের চরম সীমায়ও পৌঁছে দেয়।
আড়াল থেকে জীবন বাঁচিয়ে যুদ্ধ করার তীব্র প্রয়োজনই এই অসাধারণ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী প্রযুক্তিকে জন্ম দিয়েছিল।
আজ আমরা যখন সেই বাঁকানো ব্যারেলের বন্দুকটির দিকে তাকাই, তখন শুধু একটি অদ্ভুত অস্ত্র নয়; বরং যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা, মানবিক বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তিগত সাহসিকতার মিলিত প্রতিফলন দেখতে পাই।
কলকাতা ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিবহন ও দুর্গাপূজোর শহর | Kolkata History and Culture Full Guide
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)

Comments
Post a Comment